অন্য আর সবার মতন ঘুরা ঘুরি করার আগ্রহ ছিল কিন্তু তা নিয়ে কখন উম্মাদনা ছিল না। পাহার নিয়েও একই কথা বলা যায়। সিলেট, চট্রগ্রাম কিংবা বান্দারবান যাবার সুবাদে পাহার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল কিন্তু সেটার অনুভুতি ভাল লাগা থেকে বেশি কিছু ছিলনা। গতবছর (’১১) জানুয়ারি মাসে কেওকারাডং এর চূরায় বসে যখন দূর থেকে তা-জিং-ডং এর চূড়া মেঘ এবং কুয়াশার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম তখন পাশে বসে থাকা গাইড বলছিল তা-জিং-ডং এইখান থেকে আরও ২ দিনের পথ। আরও জানলাম তা-জিং-ডং থেকে আরও ভিতরে গেলে পাব সাকা হাফং যেটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চূড়া। কেওকারাডং এর চূড়ায় বসে লালার হোটেলে মুগী দিয়ে ভাত খেতে খেতে এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করছিলাম কেওকারাডং পর্যন্ত এসে এখান থেকে ঢাকায় ফেরত যাওয়াটা খুবই দুঃখ-জনক। ব্যাপার টা নদীর পারে এসে নদীতে গোছল না করার মতন। সঙ্গের বন্ধু কে বললাম পরের বার যেতে চায়কিনা আরো ভিতরে, অজানা কোন পথে। বন্ধু রাজি কিন্তু সমস্যা হল কিছুই তো জানিনা কিভাবে কি করতে হবে। কি করব চিন্তা করতে করতে কথা হল পাহার নিয়ে ফেইসবুকে ছবি দেয় এমন একজন বন্ধুর সঙ্গে। জানতে পারলাম তাদের একটা গ্রুপ আছে নাম ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ। আরও জানাল তারা পরের সপ্তাহেই সাকা হাফং যাচ্ছে। আফসোস হল, কেন কেওকারাডং এ গেলাম তাই। না গেলে হয়ত সাকা হাফং যেতে পারতাম। সেই বন্ধু বুদ্ধি দিল তাদের গ্রুপে যোগ দিতে আর ইভেন্ট গুলাতে চোখ রাখতে। তাই করতে থাকলাম আর সুবিধা মতন সুযোগ খুজতে থাকলাম। জুন মাসের দিকে সুবিধা মতন এটা ইভেন্ট পেয়েও গেলাম। কিন্তু সমস্যা হল ইভেন্ট টা একটা Expedition টাইপের । আমার মতন নবীন এই ট্রিপের উপযুক্ত কিনা তা নিয়ে তর্ক হবে। google.com এবং youtube.com এর কল্যানে কিছুটা বিদ্যা অর্জন করে শাহবাগে ছুটলাম। লক্ষ, যেকোন ভাবেই হোক আমি ট্রিপে যাব। অতঃপর হাজার হাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে টিকে গেলাম, যদিও ধারনা করছিলাম কয়েকজন হয় ত আমাকে নিয়ে এখন দ্ধিধার মধ্যে আছে। আমি দ্ধিধা বারার না সুযোগ দিয়ে টিকেট কাটার টাকাটা দিয়ে চলে আসলাম। আর বাসায় বসে মানসিক ও শারিরীক প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।
অতঃপর যাত্রাঃ
অতঃপর যাত্রার দিন ৩০শে জুন। সকাল থেকেই গুরি গুরি বৃষ্টি। সময় মতন অফিস থেকে বের হয়ে নির্দিষ্টি সময়ের মধ্যে বাস ছাড়ার নির্দিষ্ট স্থানে পৌছলাম। ঢাকা ছেড়ে বান্দারবানের দিকে যতই যাচ্ছিলাম বৃষ্টি ততই বাড়ছিল। ভোরবেলা আমরা যখন চট্রগ্রাম পার হলাম তখন চট্রগ্রামের রাস্তায় কেবল পানি আর পানি। আনুমানিক ১০ টা কি ১১ টার দিকে আমরা যখন বান্দরবান শহরে পৌছলাম তখন আবহাওয়া অনেকটাই ঠান্ডা। কিন্তু গত কয়দিনের টানা বৃষ্টিতে শহরের রাস্তাই চলাচলের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। পাহারী রাস্তায় হাটা যাবে কিনা তা নিয়ে অভিজ্ঞ যারা তারাই চিন্তিত হয়ে পরেছে। শেষ পর্যন্ত সিধান্ত নেওয়া হল রুমা বাজার দিয়ে না গিয়ে যাওয়া হবে থানচি দিয়ে। তাছাড়া রুমা বাজার দিয়ে গেলে হয় ত রাস্তার চেয়ে আর্মিই বেশি ঝামেলা করবে। চাঁন্দের গাড়িতে করে যখন থানচি পৌছলাম তখন ঘরির কাটায় প্রায় বিকাল ৩:৩০ বাজে। গাড়িথেকে নেমেই হাটা শুরু, পরবর্তি গন্তব্য বোর্ডিং পাড়া। আগেই বলে রাখি এর আগে আমার পাহাডী পথ দিয়ে হাটার দৌর কেওকারাডং পর্যন্ত যেটা আবার শীতকালে। এখন হাটছি থানচি থেকে বর্ডিং পাড়ার রাস্তায় যেটা আবার বর্ষাকালে। রাস্তা কেওকারাডং এর রাস্তার মতন সুন্দর না হলেও চার পাশের পাহাড়ী বুন ভাবের কারনে বেশ মজা লাগছিল। ঘন্টাখানেক এই ভাবে হাটার সময় টের পাচ্ছিলাম পাহাডী বুন ভাবটা আরও ঘন হচ্ছিল আরও টের পাচ্ছিলাম বান্দরবানের বিখ্যাত জোক আমাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ক্ষনিকের এক পশলা হালকা বৃষ্টি হয়ে যাবার পর হঠাৎ করেই আমরা জোঁক দেখা শুরু করলাম। প্রথমে একটা দুইটা করে, পরে ঝাঁকে ঝাঁকে জোঁক আমাদেরকে তাড়া দিতে থাকল। কিভাবে জোক ছাড়াতে হয় তার উপর YouTube এ কিছু ভিডিও দেখছিলাম। সেখানে কিভাবে একটা জোক ছাড়েতে হয় তার উপায় বলা ছিল কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে জোঁক থেকে বাঁচার উপায় বলা ছিল না। জোঁকের তাড়া খেয়ে আমরা একটা ঝিরির কাছে পৌছলাম। নিজেরা হাত পায়ে পানি দিয়ে পরিষ্কার হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি দলের ১০ জনের মধ্যে ৩ জন কে দেখা যাচ্ছে না। কিচ্ছুক্ষন অপেক্ষা করলাম পরে দলের একজন (সালেহীন) খুজতে গেল অন্যদের। আরো কিচ্ছুক্ষন অপেক্ষা করলাম এবার অন্য তিন জনের সঙ্গে সালেহীনেরো কোন দেখা মিললনা আবার অন্যদিকে দিনের আলো কমা শুরু করছে। কিছুটা দুঃচিন্তার শুরু। আমাদের দলনেতা সুপারম্যান খ্যাত ফয়সাল ভাই ঘোসনা দিলেন আমরা সামনের দিকে আগাব। যেহেতু সালেহীন সহ বাকী তিনজন পাহাড়ে আসার অভিজ্ঞতা আছে তারা পথ চিনে আসতে পারবে। তারা হয়ত ইতিমধ্যে রউনা দিছে অন্য কোন পথ দিয়ে। আমার নিজেরো কিছুটা ভয় লাগছিল আর কেও এইটা নিয়ে খুব বেশি কথা বাড়ালনা দেখে আমরা রউনা দিলাম বোর্ড়িং পাড়ার দিকে।
আলোঃ
পাহারে খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামে এইটা ছোটবেলায় গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম। পাহাড়ে এসে এই কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রমান পেলাম। তার উপর আমাবস্যার সময় ছিল তখন, এর সঙে যোগ হয়েছে বর্ষার মেঘ। পরিবেশ এত অন্ধকার যে আকাশের তারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলনা। এর মাঝখানেই আমরা হাটচ্ছি কাদার কারনে পিচ্ছিল রাস্তা দিয়ে সঙে জোঁকের কামর। পথ দেখার একমাত্র উপায় টর্চ লাইট। চারপাশে শুধু পাহাড়ী বুন পোকার ডাক, মাঝে মাঝেয় আমাদের কেউ পিচ্ছলা খেয়ে পরে যাবার শব্দ আর স্থাপতবিদ্যার প্রতিভাবান ছাত্রী বদ্রুর আকুতি “রাস্তা কেন শেষ হয় না” ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। অন্ধকার হবার পর কতক্ষন ধরে হাটছি জানিনা। জানিনা সবার মনের এবং শরিরের অবস্থা কি ছিল তবে বলতে দিদ্ধা নেই আমি ভিতরে ভিতরে বেশ ভয় ই পাচ্ছিলাম। সাহস পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে আমি তো আর একা নেই। যদি কোন বিপদ হয় সবাই একসাথে মোকাবেলা করব। অন্ধকার হবার ঘন্টা দুই পরেও যখন পাড়ার দেখা পেলাম না। তখন আমার মনের ভিতর সন্দেহ হতে থাকেযে আমরা পথ হারাই নাই তো আবার। উচু, নিচু, খাডা, ঢালু, সরু রাস্তা দিয়ে চলার ফাকে ফাকে আলো দেখার চেস্টা করছিলাম দূরে। জোনাকী পোকার আলো দেখে পাড়ার আলো মনে করে প্রাই ভুল করছিলাম। এভাবে চলতে চলতে হথাৎ করে নিবিরের চিৎকার। প্রথমে ভাবলাম নিবির কি কোন গর্তে পরে গেছে নাকি। পরে কাছে গিয়ে দেখলাম নিবির দূরে আলো দেখে চিৎকার দিছে। আমরা যখন বোর্ডিং পাড়ার ঝিরির পাড়ে পৌচ্ছলাম আমি টের পাচ্ছিলাম আমার গায়ে আর এক ফোটা শক্তিও বাকি নেই। ওইখান থেকে কারবারী বাড়ি পর্যন্ত কিভাবে গেছিলাম আমার মনে নাই। তবে পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরে চার পাশে তাকিয়ে যা দেখেছি সেই প্রাপ্তি আগের দিনের সব কষ্ট দূর করে দিয়েছিল।