Chat with us, powered by LiveChat

নতুন দুনিয়ার খোজে – পর্ব – ২

Share

বোর্ডিং পাড়ায় পৌছানোর পর নতুন চিন্তা মাথায় আসল। দল ছাড়া হওয়া বাকি চার জন কি আসতে পারছে নাকি তারা এখনো রাস্তা খুজে বেরাচ্ছে অন্ধকারে। হয়তো মনে মনে সবাই দোয়া করছিলাম তাদের নিরাপদে আসার জন্য। এর মদ্ধ্যে এক দাদা খবর দিলেন ঘন্টা খানেক আগে একটা দল এসেছে, তারা এখন কারবারী বাড়ীতে আছে। বর্ননা শুনে বুঝতে পারলাম ওইটা আমাদের হারিয়ে যাওয়া দলের বাকিরা। আমাদের দলনেতা তখন ঘোষনা দিলেন, যেহেতু তারা ১ ঘন্টা আগে এসেছে সুতরাং তারা যদি মুরগী রান্না না করে থাকে তাহলে হারিয়ে যাওয়ার জন্য কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। এই ঘোষনা শুনে আমরা সবাই উল্লাসে ফেটে পরলাম। মুরগী না পেলেও পাহারি সুস্বাদু আম আর কলা পেয়ে আমরা তার উপর ঝাপিয়ে পরলাম আর তাদের কে ধন্যবাদ দিতে লাগলাম। সাত জন মিলে কয়েক কেজি আম এর চার পাঁচ হালি কলা শেষ করার পরে আমাদের শরীরে যখন একটু শক্তি ফিরে এল তখন বুঝতে পারলাম কয়েক হালি জোকও তখনো আমাদের গায়ে থেকে রক্ত খাচ্ছে। ব্যকপ্যেক খুলে আমরা সবাই যখন নিজেদের ক্ষত জায়Photo Credit: Ashfaq Hasanগাগুলোতে ঔষধ লাগাচ্ছিলাম তখন সালেহীন, তুর্য ও তার দল খাবার রান্না করতে লাগল। নিজেদের গায়ে ঔষধ লাগানোর পর দেখা গেলো আমাদের কারো বিন্দুমাত্র শক্তি নেই খাওয়াদাওয়া করার। কিন্তু ফয়সাল ভাইয়ের ঝারি খেয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের খেতে বসতে হল। খাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল হয়ত খাবার শেষ করার আগেই আমি রান্না ঘরে ঘুমিয়ে পরব। কিন্তু দেখাগেল স্লিপিং ব্যেগে ঢুকার ঘন্টাখানেক পরও ঘুম আসছিল না। মনের ভিতর কেবল একটা অজানা উম্মাদনার অনুভূতি আর পরের দিনের জন্য অপেক্ষা।

প্রথম সকালঃ
আগের দিনের ক্লান্তির কারনে রাতে ঘুম হল সেইরকম। ঘুম থেকে উঠার পরে বোর্ডিং পাড়া দেখতে বের হলাম। চার পাশে ঘন সবুজ পাহার দিয়ে ঘেরা এক অপূর্ব সুন্দর একটি পাড়া। চার পাশে এত সবুজ দেখে মনের ভিতর এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করতে লাগল। সে অনুভূতি বলার ইচ্ছা করে, কিন্তু সে কথা বলার ভাষা খুজে পাইনা। শুধু এটুকুই মনে হয় ওই জায়গায় থাকা টাই আমার জীবনের সকল অর্জন, বাকি সব কিছু অর্থহীন। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করার পরে যখন কারবারী বাড়ীতে ফিরলাম তখন ফয়সাল ভাই আমাদের তাড়া দিচ্ছিল যাতে আমরা বৃষ্টি নামার আগে আমরা রউনা দিতে পারি। জায়গা টা ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছিল কিন্তু ভাল লাগছিল সামনের না দেখা সুন্দর্যের লোভে। সুপ আর নুডুলস দিয়ে সকালের খাবার শেষ করার পরে যখন আমরা রউনা দিব বলে চিন্তা করছি তখন ঝিরি পথে যাব নাকি পাহার ধরে যাব তা নিয়ে সবাই চিন্তায় পরে গেলাম। ঝিরি পথে গেলে বৃষ্টির জন্য পানি এবং স্রোত এর সমস্যা আমার পাহাড়ী রাস্তায় গেলে কাদা, জোক এর ঘন জঙ্গল। কি করব চিন্তা করতে করতে ঝিরি পথে যার সিদ্ধান্ত নিল সবাই। আর যাই হোক ঝিরি পথে গেলে তো আর জোক এর কামর খেতে হবে না। তাছাড়া পাড়ার দাদারাও বললেন সারা রাত বৃষ্টি না হবার কারনে পানি অনেক কমে গেছে।

Photo Credit: Zaqiul Deep

এবং পানিপথে যাত্রাঃ
আমরা যখন যাত্রা শুরু করলাম তখন আকাশে হাল্কা মেঘের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। সব কিছু মিলিয়ে বেশ চমৎকার আবহাওয়া। মাঝে মাঝে থেমে থেমে হাল্কা-হাল্কা গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, সঙ্গে হাল্কা ভয়ও হচ্ছিল যদি জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় তাহলে সমস্যায় পরতে হবে। হাটু সমান ঝিরির পানিতে স্রোতের বিপরীত দিকে আমরা যখন হাটছি তখন মনের ভিতর এক অদ্ভুত বুন উম্মাদনা খেলা করতে লাগল। ঠিক ২৪ ঘন্টা আগে আমরা যখন বান্দরবান শহরথেকে চাঁন্দের গাড়িতে করে থানচির উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম আজকে ঠিক সেই সময় বান্দরবান গহীনে কোন এক অজানা ঝিরি পথ ধরে হাটছি। সেই ঝিরির পানি কখনো কখনো হাটু পানি থেকে কোমরের উপর পর্যন্ত চলে আসে। তাই আমাদের কে খুব সাবধানে হাটতে হচ্ছিল। যদিও এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত ছিলাম না কারন আমাদের দলনেতা সুপারম্যান খ্যাতো ফয়সাল ভাই এত চমৎকার দেখাচ্ছিলেন যে আমরা বুঝতেও পারিনি রাস্তা কত কঠিন হত যদি ফয়সাল ভাই পথ না দেখাতেন। ঝিরি পথ দিয়ে হাটতে হাটতে পাহারী সবুজের ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য ছোট, বড় ঝরনা দেখতে পেলাম। এর মাঝেই আমরা ছবি তুলার চেষ্টা করছিলাম সেই অদ্ভুত সুন্দর জায়গা গুলার। কিন্তু দ্বীপ বেচারা যত বারই ক্যামেরা বের করার চেষ্টা করছিল ততবারই বৃষ্টি বারছিল। আমরা সবাই মিলে দ্বীপ কে ঝারি মারতে লাগলাম যাতে সে ক্যেমেরা বের না করে বাকি রাস্তায়। সবাই কত গুলা ছবি Photo Credit: Ashfaq Hasanতোলেছিল জানিনা তবে তোলার মতন যত গুলা যায়গা ছিল তার সব গুলা তুলতে গেলে কয়েকশ টেরাবাইট মেমরি লাগত। এক সময় সবাই ক্যেমেরা দিয়ে ছবি তুলা বাদ দিয়ে চোখদিয়ে ছবি তুলতে লাগল। সেই অসাধারন সুন্দর ঝিরি পথ দিয়ে হাটতে হাটতে মনে হচ্ছিল আমরা হয়ত কল্পনার কোন অগানা পথ দিয়ে হেটে যাচ্ছি যেখানে আছে ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা, বিস্নয়, পরিশ্রম, বিশ্রাম। আমরা সবাই সেই ঝিরি পথ দিয়ে হাটি মাঝে মাঝে সমান জায়গা দেখলে আমরা বসি, বসে কিছুক্ষন বিশ্রাম করে আবার হাটি। মাঝে মাঝে আমরা সেই ঝিরির স্রোতের ভিতরে আমরা নিজেদের কে ছেড়ে দেই। এই ভাবে হাটতে হাটতে আমরা যখন ঝিরির রাস্তায় শেষ মাথায় পৌছলাম সেখানে এক অভুতপূর্ব সৌন্দর্যের সন্ধান পেলাম। প্রবল বেগে ঝিরির পানি বড় বড় পাথরের গায়ে আঘাত খেয়ে জায়গাটাকে পৃথিবীর বাইরের কোন স্বর্গীয় জায়গা মনে হচ্ছিল। আমরা সবাই নিজেদের ব্যাগপ্যাক রেখে সেই স্রোতোPhoto Credit: Ashfaq Hasanস্বী পানিতে খেলায় মেতে উঠলাম। ওই পানিতে নেমে আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা সবাই কোন প্রাকৃতিক জ্যাকুজি তে গোছোল করছি। এই ভাবে কতক্ষন আমরা পানিতে দাপা দাপি করেছিলাম জানি না। তবে এক সময় আমাদের উঠতে হল সেই জ্যাকুজি থেকে। উঠার পরে আমরা বুঝতে পারলাম পানিতে থাকার কারনে আমরা সবাই জুন মাসের গরমেও রীতি মতন কাপছি ঠান্ডায়। আমরা কয়েকজন পাহারী উপায়ে হাল্কা গরম হবার চেষ্টা করে আবার হাটা শুরু করলাম, এইবার পাহারী রাস্তা দিয়ে। যেতে হবে সোজা উপর দিকে।

তা-জিং-ডং এর পাশ ঘেষেঃ
অনেক্ষন ঝিরিপথে হাটা এবং ঝিরির পানিতে দাপা দাপি করার কারনে মোটামোটি সবাই খানিকটা দুর্বল হয়ে পরেছিলাম। ঝিরি পথ থেকে যখন খাড়া পাহাড় বেয়ে আবার যখন উঠা শুরু করলাম তখন আগের দিনের জোকের কথা মনে পরে গেল। তবে ভাগ্য আমাদের ভালই ছিল বলতে হবে। জোক থাকলেও তা আগের দিনের মতন এত ব্যাপক আকারে ছিল না। দুর্বল শরীরে উঠতে কষ্ট হলেও বেশ মজা লাগছিল। আমরা হাটছিলাম পাহাড়ী ছোট ছোট জঙ্গলে এর ভিতর দিয়ে। এক দিকে বুনো পাহাড় আর অন্য দিকে গাছ পালার ফাঁক দিয়ে দূরের সবুজ পাহাড় এর সারি। বেশ অদ্ভুত এক অনুভূতি। আমরা সেই পাহাড়ী পথে কিছুদূর হাটি আবার একটু থামি, থেমে থেমে নিজেদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেই সেই জায়গায় সুস্থ শরীরে থাকতে পারার জন্য। হাটতে হাটতে আমরা এক সময় একটু দূরে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে “তা-জিং-ডং” দেখতে পেলাম। তা-জিং-ডং এতো কাছ থেকে দেখে সেখানে যাওয়ার অনেক লোভ হচ্ছিল, কিন্তু জানি এই বর্ষায় রাস্তা অনেক খারাপ হয়ে আছে ইচ্ছা থাকা সত্তেও যাওয়া টা হয়ত খুব একটা সহজ হবে না। তা-জিং-ডং গাছ পালা আর পাহাড় এর ফাঁক দিয়ে দেখেই আমাদের রওনা দিতে হল। গন্ত্যব্য বাকলাই পাড়া। এভাবে কতক্ষন হাটছিলাম মনে নাই তবে সূর্য্য যতই পর্শ্চিম দিকে হেলে পরছিল আমরা ততই চিন্তিত হয়ে পরছিলাম। মনে কেবলি ভয় আমরা যদি আবার পথ হারিয়ে ফেলি। তবে সাহস পাচ্ছিলাম এই ভেবে আগের দিন যখন রাতের অন্ধকারে পথ খুজেঁ বোর্ডিং পাড়া পর্যন্ত আসতে পেরেছিলাম আজকে বাকলাই পাড়া অবশ্যই পৌচ্ছতে পারব। যদিও সেইদিন আমরা শেষ পর্যন্ত বাকলাই পাড়া পৌচ্ছতে পারিনাই। তবে কি হয়েছিল তা অন্য এক অন্য রোমাঞ্ছকর গল্প।

Photo Credit: Ashfaq Hasan & Zaqiul Deep

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top